আলুর বাম্পার ফলন, ভালো দাম পেয়ে সন্তুষ্ট চাষী
সুলতান মাহমুদ, দিনাজপুর
প্রকাশ : ২১ ডিসেম্বর ২০২৪, ২২:০৭
দল বেঁধে নারী-পুরুষেরা নতুন সেভেন জাতের আলু উঠাচ্ছেন। টুকরি ভর্তি হচ্ছে। টুকরি ভর্তি হওয়া পর আবার বস্তায় ভর্তি করা হচ্ছে আলু। সারি সারি আলুর বস্তা জমিতেই দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে। মাত্র ৬২ দিনেই সেভেন জাতের নতুন আলু ক্ষেত থেকে হারভেস্টিং করতে পেরে সন্তুষ্ট প্রকাশ করেছেন চাষী আরিফুল ইসলাম।
দিনাজপুর সদরের উলিপুর গ্রামের শিংমারি চরে ৪৮ শতক জমিতে আলু চাষ করেছেন এই চাষী। সব মিলে আলু চাষের শুরু থেকে আলু উঠা পর্যন্ত সর্বমোট তার খরচ হয়েছে ৭৫ হাজার ৬০০ টাকা।
এই জমিতেই তার ৯০ বস্তা আলু হয়েছে। আলু উঠানোর পর আলুর খেতেই সারি সারি করে বস্তা সাজানো রয়েছে। ট্রাক্টরে বহন করে আলুর বস্তা নিয়ে যাওয়া হবে আলু বিক্রির কেন্দ্রে।
এক বস্তায় আলু ধরে ৭৫ কেজি। এতে করে তার ৪৮ শতক জমিতে ৬ হাজার ৭৫০ কেজি আলু হয়েছে। প্রতি কেজি আলু বিক্রি হচ্ছে জমি থেকেই ৪৫ টাকা। সেই হিসেবে আরিফুল ইসলামের আলু দাম হচ্ছে ৩ লক্ষ ৩ হাজার ৭৫০ টাকা।
আলু চাষী আরিফুল ইসলাম দিনাজপুর সদর উপজেলার উলিপুর গ্রামের নুর ইসলামের ছেলে।
চলতি বছরের জুন মাসে স্থানীয় শিংমারি চরের জমির মালিকের নিকট থেকে এক বছরের জন্য ৪৮ শতক জমি ৩৩ হাজার টাকায় লেজ গ্রহণ করেন তিনি।
জমি লিজ গ্রহণ করার পর আরিফুল ইসলাম এই ৪৮ শতক জমি চাষ করতে খরচ হয়েছে। জমির লিজ বাবদ প্রথম আবাদের জন্য ১১ হাজার টাকা। জমি চাষ ৩ হাজার টাকা, গোবর সার ২ হাজার ৬০০ টাকা, রাসায়নিক এমওপি, ডিওপি, টিএসপি ও, ইউরিয়া সার সব মিলে ৮ হাজার টাকা। আলুর বীজ ৩৭ হাজার ২ শত টাকা, কীটনাশক ৪ হাজার ৫ শত টাকা। পানির সেচ ২ হাজার টাকা। আলুর বস্তা ৩৬০০ টাকা এবং শ্রমিক খরচ ২ হাজার ৭ শত টাকা, পরিবহন খরচ ৩ হাজার সব মিলে তার খরচ হয়েছে ৭৫ হাজার ৬০০ টাকা। খরচ বাদ দিলে ৬২ দিনেই তার লাভ হয়েছে ৪৮ শতক জমি থেকে দুই লক্ষাধিক টাকা।
চাষী আরিফুল ইসলাম বলেন, এই সেভেন জাতের আলু চাষ করে আমি অনেক লাভবান হয়েছি। তবে এ বছর আলু বীজের দাম একটু বেশি ছিল। আলুর বীজের দাম গত বছরের মতো থাকলে হয়তো আরো বেশি টাকা লাভ করা সম্ভব হতো।
তিনি আরও বলেন, এই জমিতে এখন তেমন হাল চাষ করতে হবে না। পরবর্তী সরিষা রোপণ করব এতে করে এ জমিতে তেমন সারের প্রয়োজন হবে না। এতে করে পরবর্তী ফসলের ফলন ভাল হবে আশা করছি।
আরিফুল ইসলাম বলেন, এ বছর আগাম জাতের আলুর খেতে রোগ বালাই দেখা যায়নি তাই রোগবালাই তেমন হয়নি হলে আলু এর ফলন ভালো হয়েছে।
তিনি বলেন, আলু একটি লাভজনক ফসল অল্প সময়ের মধ্যে বেশি লাভবান হওয়া যায়। সবচেয়ে আনন্দের সংবাদ হলো জমি থেকেই আলু ব্যবসায়ীরা আলু কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। এতে করে আমার বাজারের খাজনাও দিতে হচ্ছে না। এদিকেও আমি লাভবান হচ্ছি। আলু ব্যবসায়ীর পিছনে আমাকে ঘুরতেও হচ্ছে না। নগদ টাকায় জমি থেকে আলু বিক্রয় করতে পেরে অনেক আনন্দিত।
চাষী আরিফুল ইসলামের ছোট ভাই তাজমুল ইসলাম জানান, আমরা দুই ভাই মিলে আলু চাষ করেছি। বাবার তেমন জমি নেই। লিজ নেওয়া জমিতে দুই ভাই মিলে এই আলু চাষ করেছি। বড় ভাইয়ের নির্দেশনা মোতাবেক আমি জমিতে পরিচর্যা করেছি এবং এই অল্প সময়ের মধ্যে আলু উৎপাদন করতে পেরে আমরা লাভবান হয়েছি। পাশাপাশি এই অঞ্চলের কিছু মানুষের কর্মসংস্থানের ও সুযোগ হয়েছে। আজকে আমাদের এই আলু জমিতে ১০ জন নারী শ্রমিক কাজ করছে। তারা প্রত্যেকেই ৩০০ টাকা করে হাজিরা পাবে। এতে করে তারা ও লাভবান হচ্ছে। যেহেতু এই অঞ্চলে এখন কেমন কাজ নেই। এই নারীরা ৩০০ টাকা করে আয় করলেও তাদের সংসারে কাজে লাগছে।
জমিতে আলু তুলতে আসা সাহেরা বানু বলেন, আমাদের বাড়ি উলিপুর গ্রামে। সকাল আটটার সময় আলু তুলতে এসেছি। বিকাল চারটার দিকে বাড়িতে চলে যাব। ৩০০ টাকা হাজিরা পাব। এতে করে আমার বাড়তি আয় হচ্ছে। এই আয় দিয়ে আমার নিজস্ব হাত খরচ চলবে। পাশাপাশি আমার দুটি সন্তান রয়েছে। তাদের লেখাপড়ার খরচ করতে পারব।
একই গ্রামের জহুরা বেগম বলেন, আমরা পাশাপাশি গ্রামে বসবাস করছি। আরিফুল আলু উঠাচ্ছে এবং সেই আলু নিজেও তুলে দিতে পারছি। এতে করে কিছু আমাদের আয় হচ্ছে। বসে থাকলে তো কেউ কোনো টাকা পয়সা দিবে না। তাই নিজে পরিশ্রম করে তিনশত টাকা আমিও রোজগার হচ্ছে। প্রতিদিন এতে সংসারের অনেক উপকার হচ্ছে।
আলু বহনকারী ট্রাক্টরের ড্রাইভার ফজর আলী বলেন, আমাদের এই সিংমারির চরের পাশেই আলু ট্রাকে ট্রাকে লোড হচ্ছে। আমাদের কাজ হচ্ছে আলুর জমি থেকে ট্রাক্টরে করে আলু বস্তা বোঝাই করে নিয়ে আলুর বিক্রয় পয়েন্টে নিয়ে যাওয়া। এতে করে বস্তাপতি আমরা পাচ্ছি ৭ টাকা করে পাচ্ছি। সারাদিন এই আলুর বস্তা বহন করে আমরাও ৮০০ থেকে ৯০০ টাকা আয় করছি।
ধেদার মোড়ের পাশেই আলুর ট্রাক লোড হচ্ছে সেখানকার ব্যবসায়ী রফিকুল ইসলাম বলেন, এখান থেকে প্রতিদিন এখন পাঁচ থেকে সাতটি করে ট্রাক লোড হচ্ছে। এই আলু ঢাকা সহ বিভিন্ন জেলায় পাঠানো হচ্ছে। ব্যবসায়ীরা চাষীদের কাছ থেকে সরাসরি আলু ক্রয় করছে। এতে করে চাষীরাও লাভবান হচ্ছে ব্যবসায়ী ও লাভবান হচ্ছে।
আলু ব্যবসায়ী আবুল কালাম আজাদ বলেন, আমরা ঢাকা থেকে প্রতিবছর এই চরে আলু ক্রয় করতে আসি। এ বছরও এসেছি এবং এই মাঠেই আলু ওজন করা হয়। ওজন শেষ করে ট্রাকেই আলুর বস্তা লোড করা হয়। চাষীদের কাজ হচ্ছে আলু বস্তা এই পয়েন্টে নিয়ে আসা। পরবর্তীতে ব্যবসায়ীরাই তাদের নিজস্ব ট্রাকে করে আলু দেশের বিভিন্ন পয়েন্টে নিয়ে যাচ্ছে।
দিনাজপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক নুরুজ্জামান বলেন,,এ বছর দিনাজপুর জেলায় ৪৭ হাজার ৫৫০ হেক্টর জমিতে আলুর চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মধ্যে আগাম জাতের আলু চাষ করা হয়েছে ১১ হাজার ২৫০ হেক্টর। এবার প্রতি হেক্টর জমিতে ১০ থেকে ১২ মেট্রিক টন নির্ধারণ করা হয়েছিল। তবে এ বছর আলু আমাদের অনেক ভালো হয়েছে। লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও আলুর উৎপাদন বেশি হবে বলে আশা করছি। তবে এবছর আগাম উন্নত সেভেন জাতের আলুর বাম্পার ফলন হয়েছে। এতে করে কৃষকেরাও লাভবান হচ্ছে ভোক্তারা নতুন আলু পাচ্ছে।
বাংলাদেশ জার্নাল/কেএইচ